‘অল থিং ইজ কানেক্টেড’
আমার পাশে চেয়ার বসে গেম অফ থ্রোনের ৫ম সিজনের ১ এপিসোড দেখছেন সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর, তাকে অনেকেই সাজাভাই বলে ডাকেন। এই নামে আমি শুধু লেখায় সম্বোধন করি, ডাকার সময় মনে থাকে না। জাহাঙ্গীর ভাই ডাকি। আর আমি খাটে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে তার সর্বশেষ প্রকাশিত “হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল” বইয়ের উৎসর্গের পৃষ্ঠাটি দেখছি আর স্মৃতি রোমন্থন করছি ঢাকায় কাটানো অতীতগুলি। এই রাজনীতির শহরটিতে স্থায়ীভাবে আমি প্রথম পা রাখলাম সাজাভাইয়ের সুপারিশে সাপ্তহিক লিখনীতে যখন আমার চাকরি শুরু হইছিল। এবং আমি সর্বদা স্বীকার করি, সাজাভাই ও সাপ্তাহিক লিখনী আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
“অল থিং ইজ কানেক্টেড, (সবকিছুই সংযুক্ত)”।
এই ডায়ালগটি স্মরণ রাখবেন।
লিখনী একদিন বন্ধ হয়ে গেল, একঝাঁক দুর্দান্ত প্রতিভাবান একেকদিকে ছিটে গেল। আমি এবং সাজাভাই আবারও একত্রিত হলাম হামীম কেফায়েত ভাইয়ের গালায়। অনেক অনেক দিন পর গালা ক্ষণস্থায়ীভাবে বন্ধ থাকে। আমি কেফায়েত ভাইয়ের সঙ্গে যোগ দেই ‘আজ’-এ। আর সাজাভাই তখনই ছেড়ে দিল ঢাকা। বাড়িতে কৃষিকর্ম, বধু, এবং লেখালেখি শুরু করলেন। আর আমি ফটোজার্নালিস্ট হিসাবে ‘আজ’ থেকে বেরিয়ে এসে ‘কাজীরকাজ’ শুরু করলাম।
এইটুকু হলো ইতিহাস।
কিন্তু মূল কথা হলো, ঢাকা আসার পর থেকে আমার সাথে কতজন মানুষের পরিচয় ঘটেছে? পুরানা পল্টন থেকে শাপলা চত্বর হয়ে শাহবাগ দিয়ে বাংলাবাজার, অগণিত অগণিত মানুষের সঙ্গে শুধু পরিচয় না, বন্ধুত্ব গড়েছে। সিনেমা বানাবো বলে এদিক ওদিক দৌঁড়াই, ফিল্মমেকিং বিষয়টা নিয়া এটা ওটা করি। লিটলম্যাগ করতে করতে বাংলা একাডেমিতে দৌঁড়াই। অনেকের হেল্প, অনেকের সান্নিধ্য। আর, সবশেষে দেখি, আমি ও আমরা কেউই কারো কাছে প্রয়োজনের বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। এই স্বার্থপরের বাজারে যে দুয়েকজন মানুষ এখনও আমার সময়ের সঙ্গে থেকে গেছেন, সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ভাই তার একজন। এবং, অবশ্যই একটু আগে লেখা ডায়ালগটির কথা ভোলা যাবে না।
একদিন আমি আবিষ্কার করলাম, সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর আমার দেখা এই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী কবি। এবং এখনও, আমি বিশ্বাস রাখি যদি কবিতার যথাযথ বিচার ও খোঁজ এই দেশে থেকে থাকে তাহলে কবি সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর এর ‘ইয়া আফরোজ ইয়া আফরোজা’ গ্রন্থটি একটি ঐতিহাসিক স্থান দখল করে নিবে।
...
একদিন মন ভালো নাই, আমি জাহাঙ্গীর ভাইকে বললাম, একটা ভালো মুভির নাম বলেন। সাজাভাই নাম বলেছিলেন, ‘উইন্টার ইজ টেল’। আর এটা আমি গুগলে সার্চ দিতে গিয়ে কিভাবে এটার বদলে ‘উইন্টার ইজ কামিং’ সামনে চলে এলো, আমি তখনও জানি না ‘গেম অফ থ্রোন’ কী। উইন্টার ইজ কামিং ঘাটতে গিয়ে বোঝা গেল গেম অফ থ্রোন একটা হলিউড সিরিয়াল আর ওই সিরিয়ালের প্রথম এপিসোডের নাম উইন্টার ইজ কামিং। উইন্টার ইজ কামিং দেখার পর টানা ২০ দিন আমি শুধু দুইটা কাজ করছি, একটা হল ঘুম যাওয়া, আরেকটা হল ঘুম থেকে উঠে গেম অফ থ্রোন দেখা। গেম অফ থ্রোন নিয়ে সাজাভাই আগে জানতেন, আমি আরও উদ্বুদ্ধ করলাম এবং তিনি এখন বসে বসে সম্ভবত ২য় এপিসোড শুরু করেছেন।
*মন ভালো নাই, উইন্টার ইজ টেল, উইন্টার ইজ কামিং, গেম অফ থ্রোন, ঘুম যাওয়া মুভি দেখা, আমার ওপাশে সাজাভাই। সো, অল থিং ইজ কানেক্টেড। সাজাভাইয়ের সঙ্গ আমাকে কী দিল?
চিন্তার উদারতা এবং আধ্যাত্মিকতা।
যার ভিতর কোনো লৌকিকতা নাই। কোন্ কোন্ পদ্ধতিতে চিন্তা করা যায়, এবং চিন্তাকে কত দূরে নিয়ে যাওয়া যায়, আমি তার নৈকট্যে না থাকলে কিভাবে বুঝতাম। অল থিং ইজ কানেক্টেড, এই বিষয় নিয়ে রিকশায় অনেকক্ষণ আলাপ হলো আমাদের। আমাদের না, সালাভাই একাই বলে যাচ্ছিলেন কিভাবে পৃথিবীর প্রত্যেকটা বস্তু এবং বিষয় সব একেকটার সঙ্গে সংযুক্ত। ওই রিকশার আলাপে ওইদিন আমি আগামাথা বুঝি নাই। তবে ডায়ালগটি মনে রাখছিলাম এবং চিন্তা করার রাস্তা খোলা রাখলাম।
আমি যে এখন বসে বসে এই পোস্টটা লিখছি, তার সঙ্গে আমা্র জন্মের প্রত্যেকটা সময় এবং আশপাশে প্রত্যেকটা বিষয় এবং আপনি যে বসে এটা পড়ছেন, সবকিছু দারুণভাবে কানেক্টেড।
...
একদিন বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে ১৫/২০ জন বিজেপি হাফপ্যান্ট পরে রোডবাইক বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলো অনেক দ্রুত প্যাডেল চেপে। আমি তখন মাদরাসায় পড়ি, কিশোর বয়স। ওই দৃশ্য দেখার পর আমি জিদ করলাম একদিন এইরকম চিকন চিকন চাকার একটা সাইকেল আমি কিনব। মাদরাসায় তখন আব্বা ১০টাকা ২০টাকা দিতো বিকালে নাস্তা করার জন্য। ওইসমস্ত টাকাগুলি আমি জমাইতাম সাইকেল কেনার জন্য। পাঁচবছর টাকা জমানোর পর সাড়ে দশ হাজার টাকা দিয়ে চিটাগাং নিউমার্কেট থেকে আমি সেই রোডবাইকটি কিনলাম, এবং জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা আমার, সারাদেশ সাইকেলে ভ্রমণ করার জন্য শূন্য পকেটে বেরিয়ে গেলাম প্রথমে ঢাকার উদ্দেশ্যে। আর সাইকেলে ঢাকা পৌঁছেছি এই সংবাদ সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীরের কাছে পৌঁছালো, ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে। আর তারপর ঢাকার জীবন শুরু হয়ে গেল সারাদেশ সাইকেলে ভ্রমণ করার বদলে। আর তারপরই সাপ্তাহিক লিখনী, আর তারপরই গালা, তারপরই আজ, তারপরই কাজীরকাজ, তারপরই এখন বসে বসে পোস্ট করা।
তাহলে কী দাঁড়ালো?
আমি যে এখন বসে বসে টাইপ করছি, এবং আমার বাসায় খাটের ওপাশে চেয়ারে বসে যে সাজাভাই গেইম অফ থ্রোন দেখছেন তা কী ওইদিনের সঙ্গে কোনো কানেকশন পাওয়া যায়? যেদিন বাড়ির পাশে একদল বিজেপি রোডবাইক চালিয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। তারা যদি রাস্তা দিয়ে দশ মিনিট পর বা দশ মিনিট আগে যাইত, তাইলে কী আমি এখন এইখানে থাকতাম? সাজাভাই কি এখন গেম অফ থ্রোন দেখতেন?
সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার দেখা না হলে অনেক কিছু হইত না।
( ৭ বছর আগের লেখা )
শুভ জন্মদিন পিও